মোঃ মকবুলার রহমান
স্টাফ রিপোর্টার
পবিত্র কোরবানি কেবল পশু জবাইয়ের আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি এক গভীর আত্মত্যাগ, আন্তরিকতা ও আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের বাস্তব উদাহরণ। প্রকৃত কোরবানি সেই আমল, যেখানে মুমিন তাঁর আত্মাকে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেন। এই অনন্য আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখে গেছেন হজরত ইবরাহিম (আ.)—যিনি মহান প্রভুর আদেশ পালনে কিশোর সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হন। আল্লাহ তাআলা তাঁর খাঁটি নিবেদন কবুল করে পশু কোরবানির মাধ্যমে সেই আত্মত্যাগের স্মৃতি অমর করে দেন।
তাকওয়াই কোরবানির মূল ভিত্তি
আল্লাহর কাছে পশুর মাংস বা রক্ত নয়, বরং কোরবানিদাতার অন্তরের তাকওয়া পৌঁছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—
> “আল্লাহর কাছে এগুলোর গোশত বা রক্ত পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
(সুরা হজ, আয়াত: ৩৭)
তাই এই ইবাদত পালনে বাহ্যিকতা নয়, চাই নিষ্কলুষ অন্তর, পরিপূর্ণ খালিস নিয়ত ও আন্তরিকতা। নিচে কিছু সাধারণ ভুল ও গাফিলতির কথা তুলে ধরা হলো, যেগুলো কোরবানির প্রকৃত অর্থ ও মর্যাদাকে নষ্ট করে।
১. হারাম উপার্জনে কোরবানি করা
ইবাদতের জন্য পবিত্র ও হালাল উপার্জন অপরিহার্য। হারাম পথে উপার্জিত অর্থে কোরবানি করলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। রাসুল (সা.) বলেন—
> “নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া কিছু কবুল করেন না।”
(মুসলিম, হাদিস: ২২৩৬)
২. লোক দেখানোর মানসিকতা
কোরবানি যেন লোক দেখানোর প্রতিযোগিতায় পরিণত না হয়। ইবাদতের উদ্দেশ্য হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। রিয়া (লোক দেখানো ইবাদত) এমন এক শিরক, যা গোপনে অন্তরে বাসা বাঁধে। হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
> “আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে ভয় করছি ছোট শিরক— আর তা হলো রিয়া।”
(সহিহ তারগিব: ৩২)
৩. অহংকার ও প্রতিযোগিতার মনোভাব
কোরবানির পশু নিয়ে অহংকার করা, বড় পশু কিনে অন্যকে হেয় ভাবা ইসলামী চেতনার পরিপন্থী। আল্লাহ বলেন—
> “অহংকার করে মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা কোরো না।”
(সুরা লুকমান, আয়াত: ১৮)
৪. কোরবানিকে কেন্দ্র করে যৌতুক আদায়
কোরবানির মৌসুমে কোনো কনেপক্ষের ওপর পশু দেওয়ার চাপ তৈরি করা অন্যায় এবং ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন—
> “তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ ভোগ করো না।”
(সুরা বাকারাহ, আয়াত: ১৮৮)
৫. লোকলজ্জা বা গোশতের আশায় কোরবানি করা
কোরবানি একটি ইবাদত, যা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। সমাজে সম্মান বাঁচাতে বা গোশত পাওয়ার আশায় কোরবানি করলে তা আত্মসমর্পণের উদাহরণ নয়, বরং তা কোরবানির রূহকে অপমান করে।
৬. পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা
জবেহের আগে প্রস্তুতি ছাড়া, ভোঁতা ছুরি ব্যবহার করে বা প্রয়োজনীয় সতর্কতা না নিয়ে পশুকে কষ্ট দেওয়া গোনাহের কাজ। রাসুল (সা.) বলেন—
> “তোমাদের কেউ যেন তার ছুরি ধারালো করে এবং পশুকে কষ্ট না দিয়ে আরামদায়কভাবে জবাই করে।”
(তিরমিজি, হাদিস: ১৪০৯)
৭. বিসমিল্লাহ না বলে জবাই করা
পশু জবাইয়ের সময় আল্লাহর নাম না নিলে সেই পশু হালাল নয়। আল্লাহ বলেন—
> “তোমরা আহার করো তা থেকে, যার ওপর আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে।”
(সুরা আনআম, আয়াত: ১১৮)
৮. গোশত বা চামড়া বিক্রি করা কিংবা পারিশ্রমিক দেওয়া
কোরবানির পশুর অংশ বা চামড়া বিক্রি করা কিংবা কসাইকে তা পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হারাম। রাসুল (সা.) বলেন—
> “আমি কসাইকে আমার পক্ষ থেকে পারিশ্রমিক দেব, কোরবানির চামড়া বা গোশত নয়।”
(ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩০৯৯)
শেষ কথা
কোরবানি কেবল একটি উৎসব নয়—এটি আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার বাস্তব অনুশীলন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই মহান ইবাদতটি বিশুদ্ধ নিয়ত ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালনের তাওফিক দিন। আমিন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মোঃ মকবুলার রহমান